প্রায় 20 ঘন্টা একটানা অনুসন্ধান। এর পর বৃহস্পতিবার গভীর রাতে গ্রেফতার করা হয় রাজ্যের বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে। শুক্রবার বিকেলে তাকে আদালতে পেশ করে ইডি। তিনি রেশন দুর্নীতির তদন্ত করতে মন্ত্রীকে হেফাজতে নেওয়ার অনুরোধ করেন। মন্ত্রী বলেন, তিনি অসুস্থ। ডায়াবেটিক রোগী। তার খাবার আলাদা। প্রতিদিন অনেক কিছু মেনে চলতে হয়। এ ছাড়া মন্ত্রী আদালতকে আরও বলেন, ইডি তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পায়নি। ইডিও কাউন্টার। তবে উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে আদালত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই হঠাৎ করেই মন্ত্রীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। পরে তাকে শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে শারীরিক পরীক্ষা করে মন্ত্রীকে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে ভর্তির সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরে একটি মেডিকেল বুলেটিনে জানা যায় যে জ্যোতিপ্রীর ডায়াবেটিস আরও খারাপ হয়েছে। মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব এবং শারীরিক দুর্বলতা দেখা দেয়। তদন্তে অন্যান্য শারীরিক জটিলতার কথাও বেরিয়ে এসেছে। বর্তমানে তার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল থাকলেও চিকিৎসকদের তাকে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। তাই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আদালতের নির্দেশ অনুসারে, হাসপাতাল থেকে ছাড়ার পরে, ইডি তাকে 10 দিনের জন্য তার হেফাজতে নেবে।
আদালতে নাটকীয় পরিস্থিতি
রেশন দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার জ্যোতিপরির মামলা চলছিল আদালতে। কেন তাকে হেফাজতে নেওয়া দরকার ছিল তা আদালতকে জানিয়েছিল ইডি। এরপর উত্তেজিত মন্ত্রী তার আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। হঠাৎ দেখা গেল ওজন সামলাতে না পেরে পড়ে যাচ্ছেন তিনি। কোনরকমে পাশের চেয়ারে বসল। মন্ত্রীর মেয়ে আদালত কক্ষের অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাবার কাছে ছুটে গেল সে। অনেকে চিৎকার করে অ্যাম্বুলেন্স ডাকেন। মুহূর্তের মধ্যে পাল্টে যায় আদালত কক্ষের পরিবেশ। চেয়ারে বসে মন্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন, চেয়ারে বসে থাকতেই পুলিশ তাকে বের করে দেয়। সেখানে তাকে একটি বেঞ্চে বসানো হয়। মন্ত্রী-কন্যাকে দেখা যায় বাবার মাথায় আদর করতে। অবিলম্বে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করেন মন্ত্রী-কন্যা প্রিয়দর্শিনী মল্লিক। এদিকে জ্যোতিপ্রিয়কে বমি করতে দেখা যায়। দাদা মন্ত্রীর কাছে এসে মাথা ছুঁলেন। একই সঙ্গে আদালতে ইডির বিরুদ্ধে স্লোগান উঠতে শুরু করে। মন্ত্রীর অসুস্থতার জন্য ইডিকে দায়ী করে ‘শেম অন ইডি’ স্লোগান দিতে থাকেন অনেকে। অসুস্থ মন্ত্রীকে নিয়ে যাওয়া হয় বিচারকের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে। আদালত চত্বরে অ্যাম্বুলেন্স ডাকা হয়। মন্ত্রীকে বহন করার জন্য একটি স্ট্রেচারও আনা হয়।
বালুর ইডি হেফাজতে রয়েছে
মাঝপথে শুনানি বন্ধ হয়ে যায়। আবার শুরু হলে বিচারক বলেন, জ্যোতিপ্রিয়কে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত ইডি হেফাজতে রাখতে হবে। অন্যদিকে চিকিৎসার জন্য পছন্দের হাসপাতালে যাওয়ার জন্য মন্ত্রীর আবেদনও গ্রহণ করেন বিচারক। কিন্তু ইডি এতে আপত্তি জানায়। যুক্তি হল, হাসপাতালে থাকার ফলে ইডির হেফাজতের মেয়াদ বাড়বে। ইডি-র বক্তব্য গ্রহণ করে আদালত বলেছে যে হাসপাতাল থেকে ফেরার পর মন্ত্রী জ্যোৎপরির 10 দিনের ইডি হেফাজত শুরু হবে। তবে এর পাশাপাশি আদালত ইডিকে বলেছে, মন্ত্রী সুস্থ না হলে তাকে ইডি কমান্ড হাসপাতালে নেওয়া যাবে না। এমনকি হেফাজতেও নেওয়া যাবে না। বর্তমানে তার চিকিৎসার যাবতীয় খরচ বহন করবে মল্লিক পরিবার।
ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে ভর্তি
এরপর জ্যোতিপ্রিয়কে নিয়ে একটি অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হয়। এদিকে আদালত চত্বরে দ্বিতীয় দফায় অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তার জন্য আসা কলকাতা পুলিশের অ্যাম্বুলেন্সও বাতিল করা হয়েছে। একটি দ্বিতীয় অ্যাম্বুলেন্স ডাকা হয় এবং জ্যোতিপ্রিয়কে বাইপাসের পাশে অবস্থিত একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে শারীরিক পরীক্ষার পর তাকে হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে ভর্তির সিদ্ধান্তের কথা মন্ত্রীকে জানান হাসপাতালের কর্মকর্তারা। প্রকাশিত মেডিকেল বুলেটিনে বলা হয়েছে, জ্যোতপরির সুগারের সমস্যা বেড়েছে। মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব, শারীরিক দুর্বলতা আছে। তদন্তে অন্যান্য শারীরিক জটিলতার কথাও বেরিয়ে এসেছে।
অনুসন্ধান এবং গ্রেফতার
বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটার দিকে সল্টলেকের বাড়ি থেকে মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয়কে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে 20 ঘণ্টা ধরে তাঁর বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছিল ইডি। ইডি এর আগে রেশন বিতরণ দুর্নীতির অভিযোগে ব্যবসায়ী বাকিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করেছিল। এরপরই উঠে আসে রাজ্যের বনমন্ত্রী ও প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রীর নাম। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৭টা নাগাদ সল্টলেকে মন্ত্রীর দুটি বাড়িতে তল্লাশি শুরু করে ইডির দুটি দল। এরপর একে একে মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয়া ওরফে বালুর সহকারী অমিত দে-র ফ্ল্যাটে পৌঁছয় ইডি। বন্ধু রনি ডে-র বাসায় পৌঁছে আপ্তা। কিন্তু ইডি-র তল্লাশি অভিযান এখানেই থেমে থাকেনি। হাওড়ায় মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ একটি বাড়ি এমনকি বেনিয়াটোলা লেনে বালুর পৈতৃক বাড়িতেও ব্যাপক তল্লাশি চালানো হয়েছে। রাত যত ঘনিয়ে আসছে, দেখা গেল সল্টলেকে মন্ত্রীর বাড়ির বাইরে কেন্দ্রীয় বাহিনী সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। এরপর রাত আড়াইটার দিকে বালুকে আটক করা হয়।